দুই হাজার কেজি ইলিশ ভর্তি ট্রাক ত্রিপুরার পথে!

জহির শাহ্, বিজয়নগর প্রতিনিধি,

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে বৃহস্পতিবার সকালের প্রথম আলোয় উঠে এলো এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য—একটি বিশাল ট্রাক, যার পেট ভর্তি দুই হাজার কেজি পদ্মার সোনালী ইলিশ মাছ, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা বাজারের দিকে যাত্রার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। শারদীয় দুর্গোৎসবের এই উল্লাসময় সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের এই রপ্তানি কেবল বাণিজ্যিক লেনদেনের একটি অংশ নয়, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনের এক জীবন্ত প্রতীক। এই ট্রাকটি, যা বাংলাদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘মাতাব এন্ড সন্স’ থেকে সরবরাহকৃত, ভারতীয় আমদানিকারক ‘পরিতোষ বিশ্বাস এন্ড কোম্পানি’র কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত। কাস্টমস ছাড়পত্র প্রক্রিয়ায় সিএএনডি এজেন্ট ‘শাকিয়াত কনস্ট্রাকশন’-এর দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে এই মূল্যবান কার্গো ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে প্রবেশ করবে, যেখানে দুর্গাপূজার মন্দির-প্যান্ডেল ও উৎসবমুখর ঘরে ইলিশের চকচকে সোনালী রঙে ভোগের ছবি অঙ্কিত হবে।
এই রপ্তানির পটভূমি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং বহুমুখী। বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুসারে, আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে মোট ১,২০০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানির বিশেষ অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। এই অনুমোদন পেয়েছে দেশের ৩৭টি মাছ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যাদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ৫০ টন, ২৫টি প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ৩০ টন করে মোট ৭৫০ টন, ৯টি প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ৪০ টন করে ৩৬০ টন এবং অবশিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ২০ টন করে ৪০ টন রপ্তানির কোটা নির্ধারিত হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে, এই রপ্তানি প্রক্রিয়া ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে আগামী ৫ অক্টোবরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। প্রতি কেজি ইলিশের সর্বনিম্ন রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১২.৫০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,৫২৫ টাকা। এই মূল্য নির্ধারণটি নিশ্চিত করে যে, দেশের মৎস্য খাতের কৃতিত্বকর কৃষক, জেলে এবং ব্যবসায়ীরা যথাযথ লাভবান হবেন, যা মোট রপ্তানির মাধ্যমে প্রায় ১.৫ কোটি ডলারের আয়ের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
প্রথম চালানের খবরও অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এবং ইতিবাচক। গতকাল, ১৭ সেপ্টেম্বর, দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৩৭.৪৬০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে, যা দুর্গোৎসবের বাজারে প্রথম সোনালী ঢেউ তুলেছে। এর মধ্যে খুলনার ‘আরিফ সি ফুডস’, ‘বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজ’, ‘লোকজ ফ্যাশান ও মাশফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’; চট্টগ্রামের ‘জেএস এন্টারপ্রাইস’ এবং ‘আনরাজ ফিশ প্রোডাক্টস’; যশোরের ‘লাকী ফুডস’ সহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অবদান উল্লেখযোগ্য। এই প্রথম চালানগুলো মূলত ওয়েস্ট বেঙ্গলের পেট্রাপোল সীমান্ত এবং ত্রিপুরার আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে। ফলে, কলকাতা এবং আগরতলার বাজারগুলোতে এখনই বাংলাদেশি ইলিশের উপস্থিতি অনুভূত হতে শুরু করেছে। তবে, ভারতীয় বাজারে এই ইলিশের দাম উঁচুতে উঠেছে—প্রতি কেজি ২,০০০ থেকে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত, যা পূজার সময় সাধারণ মানুষের পকেটে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, এই রপ্তানির ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও ইলিশের দাম স্থিতিশীলতা লাভ করেছে; যশোর, খুলনা এবং বরিশালের মাছ আড়তগুলোতে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের ইলিশ ৮০০-১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ইলিশ রপ্তানির এই ঐতিহ্যের ইতিহাস সমৃদ্ধ এবং উত্থান-পতনের সাথে জড়িত। একসময়, ২০১২ সাল পর্যন্ত ইলিশ রপ্তানি উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু উৎপাদন সংকট এবং অতিরিক্ত শিকারের কারণে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ২০১৯ সাল থেকে দুর্গোৎসবের বিশেষ বিবেচনায় সীমিত পরিমাণে অনুমতি দেওয়া শুরু হয়। গত বছর, ২০২৪ সালে, সরকার ২,৪২০ মেট্রিক টন রপ্তানির অনুমতি দিলেও, বাস্তবে মাত্র ১,৩০৬.৮১৩ মেট্রিক টন রপ্তানি সম্পন্ন হয়—যা অনুমোদিত পরিমাণের মাত্র ৫৪ শতাংশেরও কম। এই অসম্পূর্ণতার পেছনে ছিল মাছের উৎপাদন সংকট, অতিরিক্ত মূল্যের চাপ এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা। ফলে, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কোটা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়। এবছরও একই চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন ‘মাতাব এন্ড সন্স’-এর স্বত্বাধিকারী মাতাব শাহজাহান। তিনি বলেন, “পদ্মা, মেঘনা এবং অন্যান্য নদীতে ইলিশের উৎপাদন এবারও সীমিত; জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের প্রভাবে এটি আরও তীব্র হয়েছে। বাজার মূল্যের অস্থিরতা রপ্তানিকারকদের জন্য বড় বাধা, তবু সরকারের বিশেষ অনুমোদন আমাদের উৎসাহিত করেছে। আমরা আশা করছি, এবছরের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পারব।”
অর্থনৈতিক দিক থেকে এই রপ্তানি বাংলাদেশের মৎস্য খাতের জন্য একটি সোনার খনি, যা লক্ষাধিক জীবিকাকে স্থিতিশীল করে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলে এটি স্পষ্ট হয়: ২০২১-২২ অর্থবছরে ১,২৩০ টন রপ্তানি করে ১ কোটি ২৪ লাখ ডলার আয় হয়েছে (প্রতি কেজি গড়ে ১০ ডলারে)। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১,৩৯১ টন রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। এবছরের ১,২০০ টন রপ্তানি সফল হলে, প্রায় ১.৫ কোটি ডলারের আয় সম্ভব—যা দেশের মোট মৎস্য রপ্তানির আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠন করবে। এছাড়া, এই রপ্তানি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং অন্যান্য নদীতে ইলিশ ধরার পেশায় নির্ভরশীল লক্ষাধিক জেলে-মৎস্যজীবী পরিবারের জীবিকাকে স্থিতিশীল করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, খুলনা এবং বরিশালের জেলে সম্প্রদায়গুলোতে এই রপ্তানির ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে, পরিবেশগত চিন্তাও উঠে এসেছে। ইলিশের অতিরিক্ত শিকার উৎপাদন হ্রাস ঘটায়, যা জলবায়ু পরিবর্তন, নদী দূষণ এবং অবৈধ জালের ব্যবহারের প্রভাবে আরও তীব্র হয়েছে। সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর এবার সচেতনতা বৃদ্ধি, টেকসই শিকারের উপর জোর দিচ্ছে এবং জেলেদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে, যাতে ভবিষ্যতের দুর্গোৎসবেও এই সোনালী ঐতিহ্য অটুট থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নদী সংরক্ষণ এবং বিকল্প জীবিকা প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।
আখাউড়া স্থলবন্দরের কাস্টমস রাজস্ব কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান খান জানান, “বর্তমানে একটি ট্রাক ইলিশ-ভর্তি ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। কাগজপত্র যাচাইয়ের পর দ্রুত ছাড় দেওয়া হবে, এবং এতে বন্দরও তার মাশুল পাবে। আমরা সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছি যাতে এই বাণিজ্য অবাধ চলে।” তিনি আরও যোগ করেন, প্রতিটি ইলিশের গড় ওজন ১ কেজি ২০০ গ্রাম থেকে ১.৫ কেজি, যা রপ্তানির মানের উচ্চতা নির্দেষ্ট করে। এই ট্রাকের মতো আরও অনেক চালান আসতে পারে, কারণ ত্রিপুরা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারে চাহিদা অত্যধিক। এদিকে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের কাছে এই অনুরোধ উত্থাপিত হয়েছে, যা সরকারের বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদিত। এই রপ্তানি শুধু বাণিজ্য নয়, বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বের একটি মধুর অধ্যায়, যা দুর্গোৎসবের মঞ্চে ইলিশের স্বাদের মাধ্যমে আরও গভীর হবে।
উল্লেখ্য, এই রপ্তানির ফলে যশোর, খুলনা এবং বরিশালের মাছ আড়তগুলোতে ইলিশের দাম স্থিতিশীল হয়েছে—প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের ইলিশ ৮০০-১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সীমিত অনুমতি কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ীরা আলোচনা শুরু করেছেন। সকলের প্রত্যাশা, এবছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে, এবং দুর্গোৎসবের প্রত্যেক ঘরে পৌঁছাবে বাংলাদেশের সোনালী ইলিশের স্পর্শ। এছাড়া, এই ঘটনা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে, যা ভবিষ্যতে অন্যান্য খাদ্য রপ্তানির পথও প্রশস্ত করতে পারে। মৎস্য অধিদপ্তরের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, ইলিশের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন নিয়মাবলী চালু হয়েছে, যা জেলেদের জন্য লাইসেন্সিং এবং নির্দিষ্ট মৌসুমী শিকারের নির্দেশনা প্রদান করে। এই সকল উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইলিশ শিল্পকে টেকসই এবং লাভজনক করে তোলা সম্ভব। আখাউড়া স্থলবন্দরের এই দৃশ্য শুধু আজকের নয়, বরং দুই দেশের ভাগ্যাকুল সম্পর্কের একটি চিরস্থায়ী স্মৃতি হয়ে থাকবে।

Please follow and like us:
0
fb-share-icon20
Tweet 20
Pin Share20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *